বছর ঘুরে শীতের আমেজ আসতেই, শুরু হয়েছে গাছিদের গাছ থেকে রস সংগ্রহের প্রস্তুতি
ইকরামুল হক চুয়াডাঙ্গা প্রতিবেদক:
বছর ঘুরে শীতের আমেজ আসতেই, শুরু হয়েছে গাছিদের গাছ থেকে রস সংগ্রহের প্রস্তুতি। কাকডাকা ভোরে সূর্য পূর্ব আকাশে উঁকি দিতে শুরু করেছে। ভোরের মিষ্টি রোদ জানালা দিয়ে ঢুকে দিন শুরুর কথা জানান দিচ্ছে।
এমন সময় গৃহস্থের উঠানে রসের ভাঁড় হাজির। বাড়ির মহিলারা সেই রস জ্বালানি দেওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছেন। হয়তো এক্ষুণি ডাক পড়বে এই সাতসকালে খেঁজুরের সুমিষ্টি রসের স্বাদ গ্রহণের জন্য! দেশখ্যাত খেঁজুরের গুড় এবং পাটালি তৈরির জন্য খ্যাতি রয়েছে চুয়াডাঙ্গা জেলার। চুয়াডাঙ্গায় যে কোনো গ্রামে গেলে চোখে পড়বে মেঠোপথের দু’ধারে লম্বা খেঁজুর গাছের সারি। কোথাও আবার বিশাল খেঁজুর বাগান। শীত আসতে না আসতেই শুরু হয় এসব গাছ থেকে রস সংগ্রহের প্রস্তুতি। পৌষ-মাঘ দুই মাস খেঁজুর রসের প্রধান মৌসুম। তাইতো এই সময় খেজুর রসের স্বাদ নেয়ার জন্য রাজধানী ছেড়ে প্রতি বছর বছরই একবারের জন্য হলেও গ্রামে পা রাখেন চুয়াডাঙ্গা জেলায়, কিন্তু বর্তমান মহামারী কোরোনা ভাইরাসের ক্লান্তি সময়ে খুব বেশি মানুষ গ্রামে আসতে পারছে না।
তবে শহরে মানুষেরা গুড়-পাটালি হাতের নাগালে পেলেও খেজুরের রস পাওয়ার উপায় নেই। তাই এই রসের টানে অনেকেই ছুটে যান নিজ নিজ গ্রামে। ভোর হতে না হতেই এই অঞ্চলের বাড়িগুলোতে শুরু হয় খেঁজুর রস জ্বালানি দিয়ে গুড় কিংবা পাটালি বানানোর ব্যস্ততার সময়। তার আগেও ঘুম ভাঙ্গে গাছিদের। বাক কাঁধে কুয়াশাচ্ছন্ন অন্ধকারেই তাকে বেরিয়ে যেতে হয় গাছ থেকে রস সংগ্রহের জন্য। একের পর এক গাছে ঝোলানো ভাঁড় থেকে রস সংগ্রহ করা হয়। রস সংগ্রহের পর যেসব গাছের রস সবচেয়ে স্বচ্ছ এবং পরিষ্কার সেগুলোকে আলাদা করে রাখা হয়। এরপর বাকের দুইধারে রসের ভাঁড় ঝুলিয়ে কাঁধে উঠিয়ে নিয়ে আসা হয় বাড়িতে। রস জ্বালানি দেওয়া হয় চারকোণা আকৃতির বিশেষ চুল্লির উপরে টিনের তৈরি চারকোণা ( জালা) কড়াইয়ের মতো বিশেষ পাত্রে।
তবে গত দু’দশক আগেও চুয়াডাঙ্গার অঞ্চলে খেঁজুর রসের যে প্রাচুর্য ছিলো, সময়ের পরিক্রমায় তা অনেকখানিই পরিবর্তনের। এক সময় গ্রামের গৃহস্থ বলতেই প্রত্যেকেরই অন্তত ৫০-১০০টি খেঁজুর গাছ ছিলো। গাছের মালিকেরা নিজেই ছিলেন গাছি। তাই সকাল-বিকেলে প্রত্যেক বাড়িতেই শুরু হতো ব্যস্ততা ও আনন্দময়ের উৎসব। গাছিকে নিয়মিত বিকেলে গাছ কাটার সরঞ্জাম নিয়ে মাঠে যেতে হয়। আবার সপ্তাহের নির্দিষ্ট দিনে যেতে হয় গুড় বিক্রয়ের জন্য হাঁটে।
তবে সবচেয়ে বেশি খেঁজুর গাছ সমৃদ্ধ চুয়াডাঙ্গা সদর উপজেলার সরোজগঞ্জ অঞ্চল, এছাড়াও বাংলাদেশের বিখ্যাত গুড়ের হাটটিও সরোজগঞ্জ বাজারে অবস্থিত। শীতকালে গুড়-পাটালির জন্য এখানকার হাঁটগুলো জমজমাট হয়ে ওঠে। দূর দূরান্ত থেকে গাছিরা খেঁজুরের গুড়/পাটালি নিয়ে হাজির হয় সরোজগঞ্জ বাজারে বিক্রয়ের জন্য ।
চুয়াডাঙ্গার কুতুবপুর ইউনিয়নের নবীননগর
গ্রামের গাছি বিশারত মন্ডল জানান, আগে শীতকালজুড়ে শুধু গুড়-পাটালি বিক্রয় করেই অনেকের সংসার চলতো। কিন্তু বোরো ধান ও ভূট্রার ও সবজির চাষআবাদ শুরু হওয়ার পর থেকে খেজুরগাছগুলো মারা পড়েছে। এছাড়াও
বিভিন্ন ফসলের জন্য পানি সেচ ও সার-কীটনাশক ব্যবহারের কারণে দিন দিন গাছ থেকে রসের পরিমাণ কমেছে। তাই এখন আর আগের মতো প্রত্যেক গৃহস্থর ঘরে ঘরে গুড় পাটালির সমৃদ্ধি নেই।
তবে বছর ঘুরে শীতের আমেজ আসতেই, শুরু হয়েছে গাছিদের গাছ থেকে রস সংগ্রহের প্রস্তুতি চলছে। পৌষ-মাঘ দুই মাস খেঁজুর রসের প্রধান মৌসুম ও গাছিদের উৎসব চলতে থাকে।